মেয়ে যেদিন মারা গেল সেদিনও তৃতীয় মাত্রার চেয়ারে বসেছি : জিল্লুর রহমান
জন্ম, ছেলেবেলা ও পরিবারের কথা জানতে চাই।
জিল্লুর রহমান : জন্ম ১৯৬৫ সালের ২১ নভেম্বর। বড় হয়েছি পুরান ঢাকার নারিন্দায়। তিন ভাই আমরা।
কেমন ছিল ছেলেবেলা?
জিল্লুর রহমান : ছেলেবেলায় বন্ধু বলতে ছিল স্কুলের বন্ধুরাই। আর আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধনটা খুব মজবুত আমাদের। মহল্লায় তেমন মেলামেশা ছিল না। আব্বা ছিলেন আইনজীবী। তার বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা ছিল।
সময়টা আরো কালারফুল তো হতে পারত, তাই না?
জিল্লুর রহমান : মনে হয় এটা হয়েছে, পরিবারগুলোর শিক্ষাগত তারতম্যের কারণে। এমনিতে চেনাজানা ছিল প্রতিবেশীদের সঙ্গে। হয়তো আব্বা-আম্মা চাননি আমরা মহল্লায় খুব হইহল্লা করে বেড়াই।
শৈশবে বাবা-মায়ের হাত ধরে কোন অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে?
জিল্লুর রহমান : মূলত বই পড়ার অভ্যাস। আব্বার খুব ইংরেজিপ্রীতি ছিল। ইংরেজি বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। আর আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে বন্ধনটা খুব দৃঢ়। এখনো আমরা একসঙ্গে হলে আর কিছু লাগে না আমাদের।
খুব ধার্মিক পরিবার আপনাদের?
জিল্লুর রহমান : ধার্মিক, তবে গোড়া নয়। পর্দাপ্রথার খুব কড়াকড়িও ছিল না আমাদের পরিবারে।
আর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ?
জিল্লুর রহমান : আমার কালচারাল যোগাযোগটা গড়ে উঠেছে স্কুলের শেষের দিকে। ক্লাস টেনে পড়ার সময়। সেই সময় আমি বাম রাজনীতিতে সক্রিয় হই। সে সময়েই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গেই জড়িত হই।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বলুন?
জিল্লুর রহমান : আমি পড়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়েই আরো ভালোভাবে রাজনীতিতে জড়িত হই। আবৃত্তির সংগঠন করেছি। আবৃত্তিকার হিসেবে যত না পারফর্ম করেছি, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছি সংগঠক হিসেবে। স্বরশ্রুতির জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম। জাকসুর নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে রেকর্ড ভোট পেয়েছিলাম। আগের রেকর্ডটা ছিল হুমায়ুন ফরিদীর। সেই সময়েই বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত হই। মাস্টার্সের শেষের দিকে এসে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক হালকা হয়ে এলো। মনে হলা এটা আমার কাজ নয়। খবরের কাগজ নামের পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হই। তখন থেকে আমি আসলে সাংবাদিকতায় নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলি। রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই।
খবরের কাগজের পর?
জিল্লুর রহমান : আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ। জীবনে কখনো আমি চাকরির জন্য আবেদন করিনি।
চ্যানেল আইয়ের আগে টিভিতে কাজ করেছেন?
জিল্লুর রহমান : না। চ্যানেল আইয়ে কাজ শুরু করি ২০০৩ সালে। তার আগে রেডিওতেও কিছু কিছু কাজ করেছি। আমি সাক্ষাৎকারও দিই না। কারণ আমি মনে করি, অতটা বিখ্যাত নই আমি।
তৃতীয় মাত্রা নিয়ে বলুন।
জিল্লুর রহমান : কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের একটা জরিপ হয়েছিল, পৃথিবীর দীর্ঘতম টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। প্রথম সাতে ছিল বাংলাদেশের দুটি অনুষ্ঠান, তৃতীয় মাত্রা আর ইত্যাদি। তৃতীয় মাত্রার বিশেষ একটা ব্যাপার আছে। এটা প্রতিদিনের।
দীর্ঘদিন ধরে চলা একটা অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা একই জায়গায় থাকে?
জিল্লুর রহমান : আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, কতদিন চলবে তৃতীয় মাত্রা? আমি তাদের বলি যদি কখনো মনে হয় এ অনুষ্ঠানের মান একটুও কমেছে সেদিনই এটা বন্ধ হয়ে যাবে।
নিজের মতামত দিয়ে তৃতীয় মাত্রার আলোচনা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না আপনি। কেন?
জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ। আমি নিরপেক্ষ থাকি। আমার গেস্টরা কী বলেন, সেটা আমি দর্শকদের শোনাতে চাই। তবে আমি তাদের কাছ থেকে কথা বের করতে প্রশ্ন করি। আমি মনে করি, আমার কাজ কথা বলা নয়, বলানো। আর একটা বিষয় আমি মেনে চলি, আমার অতিথিদের অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না আমি।
প্রতিদিন এমন একটা অনুষ্ঠান কীভাবে সম্ভব? বিকল্প কোনো হোস্ট তো নেই। আপনি তো অসুস্থও হতে পারেন? কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন?
জিল্লুর রহমান : যেদিন আমার বোন মারা গেলেন, সেদিনও আমি তৃতীয় মাত্রা করেছি। আমার বাবা মারা গেছেন, করেছি। আমার মেয়ে যেদিন মারা গেছে, সেদিনও তৃতীয় মাত্রার চেয়ারে বসেছি। তৃতীয় মাত্রার জন্য আমি কোনো টক শোর অতিথি হই না। আমার মনে হয়েছে, আমার নিরপেক্ষ থাকা খুব জরুরি। আমি ভোটও দেই না। ভোট দেওয়াও এক ধরনের পক্ষপাত। এমনকি ফেসবুকে আমি কোনো রাজনৈতিক স্ট্যাটাসও দেই না। কারণ, ওইটা দিয়েই আমাকে বিচারের চেষ্টা হবে। তেরো বছর ধরে এটা আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। অনেকে বলেন, জিল্লুরের আছে দুটো বিষয়, একটা তৃতীয় মাত্রা আর একটা ফ্যামিলি। দেশের বাইরে গেলে আমি রেকর্ডিং করে যাই। এমনভাবে কথা বলি যেন দর্শক ভাবে, আমি লাইভ। অনেক সময় বিশেষ ঘটনা ঘটে যায়। আমি যতদূর সম্ভব সেগুলোর আগাম ধারণা নিয়ে অনুষ্ঠান করে দিয়ে যাই।
তৃতীয় মাত্রার সব বিষয় আপনি ঠিক করেন?
জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ। সবই আমার ঠিক করা। আমার অফিস থেকে এই স্বাধীনতা পাই। সাধারণত দিনের প্রোগ্রাম দিনে করি। তবে স্পেশাল ইভেন্টের ক্ষেত্রে লাইভ করি। যেমন হলি আর্টিজান নিয়ে সেদিন রাতেই লাইভ অনুষ্ঠান করেছি।
তৃতীয় মাত্রার ধারণা কীভাবে মাথায় এলো?
জিল্লুর রহমান : সে সময় বাংলাদেশের সংসদ একদম অ্যাকটিভ ছিল না। বিরোধী দল সংসদে যায় না। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও যায় না একসঙ্গে। তাদের মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়ার বিষয়টাই মাথায় ছিল।
টিভি ক্যামেরায় কতটা স্বচ্ছন্দ?
জিল্লুর রহমান : এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। মেকআপ করা হয় না তেমন। আমি আর আমার গেস্ট সবাই মুখে শুধু একটু পাফ নিয়ে ক্যামেরায় বসে যাই।
তৃতীয় মাত্রা ছাড়া আর কী করেন?
জিল্লুর রহমান : আমাদের একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সিসিএন। এটা মূলত সোসাল ইস্যু নিয়ে কাজ করে। আমাদের একটা জার্নাল বেরবে। এটাকে থিংক ট্যাংক বলা যেতে পারে। মিডিয়া কন্সালটিংয়ের ব্যবসাও করি।
আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে কী ভাবেন?
জিল্লুর রহমান : আমাদের মূল সমস্যা হলো অপব্যবহার। যার হাতে কলম আছে সে সেটার অপব্যবহার করে। যার ক্ষমতা আছে সে সেটা অপব্যবহার করে। যারা হাতের ধর্ম আছে তারা সেটার অপব্যবহার করে। আমি তো অনেক দেশ ঘুরেছি। আমার সব সময় মনে হয়, আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এমনকি মানবিক গুণাবলিরও অভাব আমাদের। আমাদের অনেক কিছু নেই আসলে। শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতেই হবে।
আপনার বই?
জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ। প্রবন্ধের বই। আর দুটি সম্পাদনা।
এসব বইয়ে কী আপনার নিজের রাজনৈতিক মতামত আসেনি?
এসব আমি তৃতীয় মাত্রার আগে করেছি। এখন আমি আমার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এমন কিছুই করি না।
নাটক, সিনেমা, গান?
জিল্লুর রহমান : আমি ছেলেমেদেয়ের বলি প্রতিদিন অন্তত একটা গান শুনবে। সপ্তাহে একটা সিনেমা দেখবে। আর মাসে একটা বই পড়বে। আমিও মেনে চলি এ নিয়ম।
জীবন দর্শন?
জিল্লুর রহমান : আমি একটা বিষয় মেনে চলি। আমার দ্বারা যেন কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। আবার মানুষ যেন আমার ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য সতর্ক থাকি। আর আমার দেশকে আমি খুব ভালোবাসি। যেমনই হোক, ভালোবাসি। ছেলেমেয়েরা যেন দেশেই থাকে, চাই।
আপনজন হারানোর কষ্ট কীভাবে সামলে ওঠেন?
জিল্লুর রহমান : আমার এক ভাই মারা গেছে দশ বছর বয়সে, এক বোন মারা গেছে। বাবা মারা গেছেন। আর আমার চার মাস বয়সী শিশুকন্যা আমাকে ছেড়ে গেছে। সেই নিদারুণ কষ্টের সময়গুলো পরিবারের সদস্যরা পরস্পরকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরেছি। আর আমার কাজ আমাকে সেই প্রবল দুঃখ থেকে বের করে এনেছে।
আপনার আশাবাদ ...?
জিল্লুর রহমান : আমি বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী। তারুণ্যের দেশ বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। তবে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। অনেক কিছু অর্জন করতে হবে। মানবিক হতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষা জরুরি। ধর্মকে গ্রহণ করতে হবে মানবকল্যাণের অনুকূলে।
ভালো থাকবেন।
জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ। ধন্যবাদ।
Content Courtesy: http://www.protidinersangbad.com/todays-newspaper/feature/soptok/