সেনাবাহিনীকে অবশ্যইদেখতে হয় দেশকোন দিকে যাচ্ছে
সম্প্রতি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব বিষয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া যা বলেছেন, এটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বাস্তবধর্মী চিন্তাশক্তি এবং প্রচুর গবেষণার ফল। কারণ, এই কথাগুলো তিনি এমন একটা সময় বলেছেন, যখন দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় তার কথা থেকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে অন্তত একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মঙ্গলবার মধ্যরাতে একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত অনুষ্ঠান 'তৃতীয় মাত্রা' নামের এই টক শোতে আরো অংশ নেন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের প্রতিমন্ত্রী (পরবর্তীতে দলত্যাগ করে এলডিপিতে যোগদান এবং বর্তমানে নিষ্ক্রিয়) আলমগীর কবির। আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান আরো বলেন, দেশে এখন এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেটা এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক একটা পারিবারিক শাসন, সেখানে গণতন্ত্র একেবারেই অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে এবং এ নিয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নাই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা গত কয়েক বছর ধরে দেশের যে পরিচালনা প্রক্রিয়া দেখে এসেছি, তাতে গণতান্ত্রিক আচরণের কতটুকু ছিল? তেমন কোনো প্রক্রিয়াই সেখানে দেখা যায়নি। দেশে এখন ভয়াবহ এক অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মানবতা বিরোধী অপরাধের যে ট্রায়ালগুলো হচ্ছে, সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক; কিন্তু সেগুলো হওয়ার ভিতর দিয়ে এমন কিছু বাস্তবতা উঠে আসছে যে, যেগুলোকে অনেকেই হয়তো গৃহযুদ্ধ বলছেন; কিন্তু আমি সেভাবে না বললেও এটা তো ঠিক যে, ব্যাপারগুলো দেশকে মারাত্মক বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। হিংসাত্মক কার্যকলাপ প্রকট হয়ে উঠেছে। হরতালের পরিণতিগুলো দেশের যে ধারাবাহিক স্থিতি, সেটা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই আজ প্রশ্ন উঠছে, কাদের স্বার্থে এসব? কারা এতে লাভবান হচ্ছে? এই যে ঘৃণার প্রক্রিয়া, তাতে অনেক উন্নয়ন এজেন্ডা চাপা পড়ে যাচ্ছে। যেভাবে আমরা শিল্পায়নের পথে যাচ্ছিলাম, পৃথিবীর ১৩টি উদীয়মান অর্থনীতির একটি হিসাবে আমাদের বিবেচনা করা হচ্ছিল। অনেক কিছুতেই আমরা এক নম্বরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেই দেশ কেন আজ জেনেশুনে এমন এক অন্ধকারে ঝাঁপ দিচ্ছে, যে অন্ধকার ইচ্ছে করলেই আমরা এড়িয়ে যেতে পারি, যে বিষয়গুলো আমরা কৌশলে মোকাবেলা করতে পারি; কিন্তু এগুলোর সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিরোধী দলীয় নেত্রী যে কথাগুলো বলেছেন, তাতে বাস্তবতা রয়েছে, এটা অবাস্তব নয়। এটা ঠিক যে, একটা দেশের সেনাবাহিনী সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। সেই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই দেখতে হয় যে, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। আমি আশা করবো যে, তারা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যক্ত করবে। যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো এমন পর্যায়ে যেন না যায়, যাতে পরিস্থিতি পয়েন্ট অব নো রিটার্নের জায়গায় চলে যাবে।তিনি বলেন, একটা দেশে গণতন্ত্র প্রস্ফুটিত হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে গণতন্ত্রের সচেতনতা, সততা বা চলমান প্রক্রিয়া মনিটর করা সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের একটা স্বাভাবিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। এই দায়িত্ব পালন না করাটাই বরং অস্বাভাবিক মনে হবে। তবে আমি কোনোভাবেই মনে করি না যে, গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন করা উচিত; কিন্তু আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যে ক্রম ধারা, সেটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা আমাদের বন্ধু দেশ, তারা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক একবার না করে দিয়েও আবার ফিরে এসেছিল; কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার গুটিয়ে নিয়েছে। এটা নাগরিকদের কাছে অত্যন্ত অসহনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য একটা ব্যাপার। কেন আমরা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলাম? সেখানে কি জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, নাকি কোনো ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে? এসব দিক চিন্তা করলে মনে হয় যে, বিরোধী দলীয় নেত্রীর অভিব্যক্তি অত্যন্ত ম্যাচিউরড। তিনি যথেষ্ট বাস্তবধর্মী। এই কদিন আগে আমাদের রাষ্ট্রপতি মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসলেন। অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো পিছিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রতি তিনি যথেষ্ট মর্যাদাও দেখালেন; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, দেশের বাস্তব পরিস্থিতি থেকে তিনি সরে যাবেন। আমি মনে করি, তিনি যথাসময়েই বাস্তবতা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিনি যা বলেছেন, প্রকৃত অর্থেই সত্যি কথা বলেছেন।
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে সেটা অত্যন্ত আপত্তিকর এবং এই ক্ষেত্রে জনমতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। অথচ এই ব্যবস্থা চালুর সময় আজকের ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলে ছিল এবং ওই অবস্থায় তারাই প্রথম বুঝতে পারে যে, একটি দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ কারণে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তখন বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের আন্দোলনের মুখেই তখনকার ক্ষমতাসীনরা এটা মেনে নিয়েছিল। আজকে তারা যখন ক্ষমতায়, দেশের সকল নিরাপত্তাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে, এমন সুবিধাজনক জায়গায় বসেই তারা বলছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার নেই। হিসাব করলে দেখা যাবে যে, দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে। এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে অগ্রাহ্য করে কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দেয়া যায়? এটা সম্পূর্ণরূপে একটি অবাস্তব ও ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ। পার্লামেন্টে নিজেদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই তারা এটা করেছে। এখানেই আমাদের গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আজ যদি তারা বিরোধী দলে থেকে এই দাবি করতো, তাহলে সেটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারতো। কারণ, একদিন বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়ই তারা আন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে সংশোধনের চিন্তা না করা হলে মানুষ অবশ্যই তৃতীয় শক্তির কথা চিন্তা করবে।
তিনি বলেন, নব্বই পরবর্তীকালে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, গণতন্ত্রই হচ্ছে আমাদের জন্য একমাত্র যথোপযুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা; কিন্তু এ ধরনের আচরণগুলোই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা যতোই সেক্যুলারিজমের কথা বলি, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এদেশের মানুষ ধর্মভীরু, যদিও তারা ধর্মান্ধ নয়। অবশ্য এ জন্য আমাদের আরো পেছনে ফিরে যেতে হবে। ১৯৪৭ সালে যেভাবে এই দেশটি তৈরি হয় সেটা এভাবে হওয়ার কথা ছিল না। তখন আমাদের নেতা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তার নেতৃত্বে বেঙ্গল এবং আসাম নিয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র করার পরিকল্পনা ছিল, যেটা লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন অনুমোদন করেছিলেন। এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও মাথা নেড়ে তাতে সায় দিয়েছিলেন। ইতিহাসের বই পড়লে সেটার প্রমাণ পাওয়া যাবে। মাউন্ট ব্যাটেনের মৃত্যুর ছয় মাস আগে দুইজন ফরাসি সাংবাদিক তার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ওয়ান্ডারফুল পরিকল্পনা ছিল। তিনি একটি সত্যিকার সেক্যুলার রাষ্ট্র করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটা না হওয়ার কারণ ছিল একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী সেদিন কলকাতায় বসে গান্ধী আর নেহেরুর প্ররোচনায় এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি। সেটা হয়নি বলেই আমরা এমন একটা ল্যান্ড পেয়েছি, যেখানে আমরা আসাম হারিয়েছি, কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ হারিয়েছি। আমরা অনেকটা পোকায় কাটা একটা দেশ পেয়েছি। এটা এমন হতো না, যদি সেদিন সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই ইস্যুতে পরবর্তীতে ছাড় না দিতেন, বিষয়টির পেছনে লেগে থাকতেন। সে কারণেই তার স্বপ্নের সেক্যুলার বাংলা গড়া যায়নি। আর সেই সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়া যায়নি বলেই আজকের বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিয়েছি। এখন আমরা ইচ্ছে করলেই তো ১৯৪৭ সালের গুরুত্বটাকে উপেক্ষা করতে পারবো না। কারণ, খুঁটিকে তো আর বাদ দেয়া যায় না। এখন যদি কেউ বলেন যে, ধর্মকে সরিয়ে দিতে হবে এবং সেক্যুলার ধারণাগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হবে, তাহলে আমাদের যে সীমান্ত তৈরি হয়েছে, সেটার যৌক্তিকতাগুলো কোথায় যাবে? আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে সামনে রেখেই এই সীমান্ত রয়েছে। কাজেই এ প্রথম বারের মতো আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে এই ভেবে যে, আমাদের এই জাতিসত্তাকে আমরা যার ভিত্তিতে টিকিয়ে রেখেছি, সেটা কি হারিয়ে যাবে? যদি এমন কখনো হয় যে, এই জাতিসত্তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেই ভয়টা কি নেই? আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ১৯৪৭ সাল ছাড়া ১৯৭১ সাল চিন্তাই করা যেতো না। যারা '৪৭ বাদ দিয়ে '৭১ চিন্তা করতে চান, তারাই মূলত বড় রকমের দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে খুবই সচেতন বলে মনে হচ্ছে। এখানে কোনো রকম অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে সেটা তাদের স্বার্থের জন্যও ক্ষতির কারণ হবে; কিন্তু আমরা এখন যেদিকে যাচ্ছি, আগামী কয়েক মাস এখানে যে অবস্থা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই সুখকর হবে না। সুতরাং পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে বিরোধী দলীয় নেত্রী যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়।